ইসরায়েলি হামলায় নিহত হওয়ার আগে কী লিখে গেছেন সাংবাদিক শরীফ

ফিলিস্তিনের গাজা সিটিতে ইসরায়েলি হামলা নিহত হয়েছেন আল-জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ ও তাঁর চার সহকর্মী। হামলার সময় তাঁরা সাংবাদিকদের থাকার জন্য বানানো একটি তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন।

স্থানীয় সময় গতকাল রোববার সন্ধ্যায় গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাইরে অবস্থিত তাঁবুতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় মোট সাতজন নিহত হন।

হামলায় নিহত অন্য সংবাদকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন আল-জাজিরার সংবাদদাতা মোহাম্মদ কুরেইকেহ ও ক্যামেরা অপারেটর ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নওফাল ও মোয়ামেন আলিওয়া।

২৮ বছর বয়সী আনাস আল-শরীফ ছিলেন আল-জাজিরা আরবির পরিচিত মুখ। তিনি গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করছিলেন।

নিহত হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই এক্সে (সাবেক টুইটার) শরীফ লিখেছিলেন, গাজা সিটির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে তীব্র ও লক্ষ্যকেন্দ্রিক বোমাবর্ষণ শুরু করেছে ইসরায়েল। এ ধরনের বোমাবর্ষণ ‘ফায়ার বেল্ট’ নামে পরিচিত।

শরীফের শেষ ভিডিওটি রাতের বেলা ধারণ করা। ভিডিওতে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তীব্র আওয়াজ শোনা যায়। হামলার পর মুহূর্তে কমলা আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে গাজার রাতের আকাশ।

গত ৬ এপ্রিল শরীফ একটি ‘শেষ বার্তা’ লেখেন। মৃত্যুর পর প্রকাশের জন্য এই বার্তা রেখে গিয়েছিলেন তিনি।

বার্তায় শরীফ লিখেছিলেন, তিনি যন্ত্রণার প্রতিটি ক্ষুদ্রতম রূপ অনুভব করেছেন। বারবার দুঃখ ও ক্ষতির স্বাদ পেয়েছেন।

শরীফ আরও লিখেছেন, ‘তবু আমি কখনো দ্বিধা করিনি সত্য যেমন আছে, ঠিক তেমনই, বিন্দুমাত্র বিকৃতি বা ভ্রান্তি ছাড়াই তুলে ধরতে। আমার একমাত্র আশা ছিল, আল্লাহ যেন সাক্ষী থাকেন তাঁদের প্রতি, যাঁরা নীরব থেকেছেন, যাঁরা আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছেন, আর যাঁরা আমাদের শ্বাস পর্যন্ত রুদ্ধ করেছেন।’

শরীফ লিখেছেন, ‘আমাদের শিশু ও নারীদের ক্ষতবিক্ষত দেহও তাঁদের হৃদয়কে নড়াতে পারেনি, কিংবা দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের জনগণের ওপর চলা হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি।’

শরীফ আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, স্ত্রী বায়ান, ছেলে সালাহ ও মেয়ে শামকে রেখে হয়তো তাঁর চলে যেতে হতে পারে। ছেলে-মেয়ের বড় হওয়াটা হয়তো তিনি দেখে নাও যেতে পারেন। এ জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।

আল-জাজিরার নিন্দা

ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের পাঁচজন সংবাদকর্মীর একসঙ্গে নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আল-জাজিরা।

এক বিবৃতিতে আল-জাজিরা বলেছে, এটা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি নগ্ন ও পূর্বপরিকল্পিত হামলা।

বিবৃতিতে বলা হয়, গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহ পরিণতির মধ্যেই এই আক্রমণ চালানো হয়েছে। গাজায় বেসামরিক মানুষদের অবিরাম ও নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। জোর করে অনাহারে রাখা হচ্ছে। পুরো সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

আল-জাজিরা বলেছে, গাজায় অন্যতম সাহসী সাংবাদিক শরীফ ও তাঁর সহকর্মীদের হত্যার নির্দেশ উপত্যকাটি দখল ও দখলদারির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বরকে নীরব করার এক মরিয়া প্রচেষ্টা।

গাজায় চলমান গণহত্যা ও সংবাদকর্মীদের ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সব প্রাসঙ্গিক সংস্থাকে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আল-জাজিরা।

শরীফ ও তাঁর সহকর্মীদের ওপর ইসরায়েলি হামলার সময় ঘটনাস্থল থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে ছিলেন আল-জাজিরা ইংরেজির সংবাদদাতা হানি মাহমুদ। তিনি বলেন, গত ২২ মাসের যুদ্ধে সহকর্মী শরীফের মৃত্যুর খবর প্রচার করা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ।

হানি মাহমুদ বলেন, গাজার ফিলিস্তিনিদের অনাহার, অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে নিরলসভাবে প্রতিবেদন করার কারণেই সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে। কেননা তাঁরা এ অপরাধের সত্যতা সবার সামনে তুলে ধরছিলেন।

শরীফকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার কথা নিশ্চিত করে একটি বিবৃতি দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, হামাসের একটি সেলের প্রধান ছিলেন শরীফ। ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক ও সেনাদের ওপর রকেট হামলা পরিচালনায় তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে তারা। তারা দাবি করেছে, তাদের কাছে তাঁর ফিলিস্তিনি সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহাতীত প্রমাণসংবলিত নথি রয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংস্থা ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদা বলেন, শরীফের সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করাই ছিল তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *